ভালবাশার গল্প : যে দেয়ালটি মিনতির বন্ধু ছিল

ভালবাশার গল্প : যে দেয়ালটি মিনতির বন্ধু ছিল 

লিখেছেনঃ  বিকেল চড়ুই

ক্লাসের শেষ বেঞ্চটা খালি পড়ে থাকে।কয়েকদিন ধরে বেঞ্চের একচ্ছত্র অধিপতি মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছেনা।আমি জ্যামিতি ক্লাসে বিমান স্যারের বুঝিয়ে দেয়া উপপাদ্য খাতায় তুলতে তুলতে বারবার পিছনে তাকাই।

ক্লাসে আমরা ভাল ছাত্রীর দলে ছিলাম।নিয়মিত স্কুলে আসতাম। খাতায় বাড়ির কাজ তোলা থাকত ।শিক্ষকদের প্রশংসায় ভেসে যেতাম।
আমরা বসতাম সামনের বেঞ্চে। মিনতি বসত পেছনের বেঞ্চে।
প্রায়ই দেরিতে স্কুলে আসে।এক বেনীতে ফিতা থাকেতো আরেক বেনীতে নেই।স্কুল ড্রেস কালেভদ্রে ইস্ত্রি করা থাকে।সপ্তাহে অন্তত একবার ব্যায়াম দিদিমনির হাতে মার খায়।স্কুলে শারীরিক শিক্ষার দিদিমনিকে আমরা ব্যায়াম দিদিমনি ডাকতাম। কড়া মেজাজের মানুষ। স্কুল আসতে পাঁচ মিনিট দেরি হলেই ইয়া মোটা ডান্ডার বাড়ি পড়ত পিঠে।
মিনতি একটা চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে।স্কুলে আসে,সাতটা ঘন্টা চুপচাপ বসে থাকে।টিফিন ঘন্টায় আমরা যখন দুরন্ত খরগোশের মত ছুটোছুটি করি মেয়েটা তখন ক্লাসরুমের পেছনের জানালাটা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে ।
কেউ ওর সাথে গায়ে পড়ে কথা বলতে যায়না।ওকে আমাদের কাছে রহস্যময়ী মনে হতো।

আমি যেদিন প্রথম এই স্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাস করতে এলাম ক্লাসরুমে আর কোথাও জায়গা না পেয়ে বসতে গেলাম ওর পাশে ।
-এখানে আর কেউ বসেছে ?
মেয়েটা প্রথমটায় যেন বুঝতেই পারলনা আমি ওকে কিছু বলেছি পরে ডানে বায়ে মাথা নাড়ল ।
-নাম কী তোমার ?
-মিনতি দে
-ও আমার নাম জাহান
নাম শুনে মিনতির ঠোঁটের ফাঁকে দাঁত কখানা ঝিলিক দিয়ে উঠল ।
আমি আলাপ জমাতে চাইছিলাম কিন্তু পারলাম না। মিনতি নির্ভেজাল শ্রোতা কিন্তু আমিতো শুধু বকতে জানিনা প্রশ্ন ছুঁড়তে ছুঁড়তে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।
যতদূর জেনেছিলাম ওর বাবা মা ছোটবেলায় মারা গেছেন।দাদীর কাছে মানুষ হয়েছে।দাদীর সাথে ওর কাকার বাসায় থাকে।দাদী চোখে দেখেনা। কাকী ওকে অত টা ভালবাসেনা।
কথা বলতে বলতে আমার মনে হয়েছিল মেয়েটা বড্ডো চাপা স্বভাবের।

একদিন থার্ড পিরিয়ডে ক্লাস নাইন বিজ্ঞান শাখার বাংলা ক্লাসটা হলোনা। শিলবৃষ্টি হচ্ছিলো তুমুলসে। ক্লাসের সবাই রৈ রৈ করে বেরিয়ে গেলাম!দোতালার বারান্দায় হাত পেতে দিলাম ,শিল ধরার চেষ্টা করছিলাম,কুড়িয়ে নিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছিলাম।
এর মধ্যে আমি ডেস্কে ফিরে এসেছি আমার পানির বোতলটা নিতে হঠাত্‍ মৃদু একটা শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি মিনতি জানালার গ্রীল ধরে দাড়িয়ে একা একা হাসছে।কার সাথে যেন কথা বলছে।
আমি অবাক হয়ে ওর কাছে গেলাম।
-এই কার সাথে কথা বলছ ?
মিনতি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখতে পেয়েই ফ্যাকাশে হয়ে গেল ।ভীত কন্ঠে বলল,কই কারো সাথে না।

আমার খটকা লাগল।কাছে এসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। মেঘে মেঘে আচ্ছন্ন কয়লা রঙের এক চিলতে আকাশ ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনা।

আচমকা দেখি মিনতি গোঁ গোঁ শব্দ করে লুটিয়ে পড়ছে। আমি কি হল বুঝতে না পেরে চিল চিত্‍কার ছেড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।
-এই মিনতি এই!

# #
সেদিন মিনতিকে স্কুল থেকে এম্বুলেন্সে করে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হলো।
ওর কী একটা অসুখ হয়েছে। ক্লাসের সবাই বলছিল মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে।

আমার খুব মন খারাপ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সবাই মিলে ওকে একবার দেখতে যাওয়া উচিত।

স্কুল ছুটির পর আমি কী ভেবে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসেছিলাম । আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাত্‍ চোখ ফেরালাম বেঞ্চ লাগোয়া কর্ণারের দেয়ালের দিকে। গুটিগুটি হরফে কিছু একটা লেখা। চোখ কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।
ভাল পড়া যাচ্ছিলনা। পেন্সিলের নরম শীষে লেখা।
ভাঙাচোরা হাতের লেখা পড়তে পড়তে আমার মাথায় আগুন ধরে গেল।

“আচ্ছা তোমরা যখন গভীর রাতে মায়ের বুকে গুটিশুটি মেরে ঘুমাও কত আনন্দে ঘুমাও তাই না ? আমি তখন পৃথিবীর সব দেব দেবীকে ডেকে কত্ত কাঁদি জানো। আমার কথা কেন কেউ শোনেনা। রাত হলেই আমি খুব কষ্টে থাকিগো। অনেক কষ্ট। ”

“ওগো ঠাকুর আমাকেও আমার বাবা আর মা মনির কাছে নিয়ে যাও।”
“দাদী বেঁচে না থাকলে আজ আমি দোতালার বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে মরে যেতুম ”

” অনেক ব্যথা। কেউ আমায় ভালবাসেনা। এই দেয়াল তুই আমার বন্ধু হবি ?”

“দেয়ালবন্ধু আমি কাল দাদীকে বলতে গিয়েছিলাম দাদী আমাকে বেশ্যা বলে গাল পেড়েছে। দেখেছ তোমার কথা শুনে গাল খেলাম ।”

“হিরন আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে সোমা দির বাসায় যাওয়ার সময ওর টিপ পরেছিলামতো। গতকাল কাকা আমার গলা টিপে ধরেছে। বলেছে কাউকে বললে,আমাকে জবাই করবে। ”

“কত্ত পায়ে পড়ি ও দেয়ালবন্ধু মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন ?”

একটা লেখার উপর আরেকটা লেখা চলে গেছে। আলাদা করার উপায় নেই। পড়তে পড়তে আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাণপনে চোখের পানি সামলালাম।দেয়ালজুড়ে অপ্রকৃতস্থ এক কিশোরীর হিজিবিজি লেখা কারো চোখে পড়েনি এতকাল।কেউ আসেনা এই এখানে,কেউ বসেনা মেয়েটার পাশে।কত ঝিমধরা দুপুরে টিফিন ঘন্টায় মেয়েটা চুপচাপ দেয়ালে লিখে গেছে কারো চোখে পড়েনি।

“কাকা কাল আমাকে অনেক ব্যথা দিয়েছে।কামড় দিয়েছে।রক্ত পড়েছে ,ব্যথা পেয়েছি। শুক্রবার কেন স্কুল খোলা থাকেনা দেয়াল বন্ধু? শুক্রবার দুপুরে কেন বাসায় কেউ থাকেনা?”

“দেয়ালবন্ধু, আমি তোমাকে ভালবাসি”
“তুমি এত ভাল কেন? তুমি আমাকে একটু আদর করবে বন্ধু ? একটু ভালবাসবে ?”

“একটা দেয়াল আমার বন্ধু । লক্ষী বন্ধু।”
“মিনতি একটা খারাপ মেয়ে”
“দেয়াল দেয়াল দুঃখী দেয়াল বলনা তুই কেন এত তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে যায়?”

আমার পক্ষে আর পড়া সম্ভব হচ্ছিলোনা।

আমি এক ছুটে ক্লাসরুমের বাইরে বেরিয়ে গেলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে দোতালা পেরিয়ে একতলা পেরিয়ে করিডোর ফেলে মাঠের মাঝখানে গিয়ে
ঝুপ করে স্কুল ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে হুহু করে কেঁদে ফেললাম। একটা বিশাল নীল আকাশ। সবুজ ঘাসে মুখ ডুবিয়ে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। আমার কল্পনায় একটা শুক্রবারের দুপুর ভেসে আসছে । মিনতি নামের ছোটখাট লাবন্যময়ী মেয়েটা ভীত পাখির মত লুকাতে চাইছে বাসার কোন কোণায়। একটা কিলবিলে কালো হাত ওকে জড়িয়ে ধরছে ,ভয়ার্ত চোখে ছোট্ট মেয়েটা পালাতে চাইছে। পারছেনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। একটা হাত ওর শরীরটাকে বিছানায় ছুড়ে ফেলছে.. ওর মুখ চেপে ধরেছে..চাপা ফুলের মত মুখ..
আমি ফিসফিস করে বললাম,হে আল্লাহ মিনতি কেন আমার ছোট বোন হলনা?

Related posts

Leave a Comment